এ কিংবদন্তি মনে হয়,কেবল জগন্নাথ দেবের অসম্পূর্ণ বিগ্রহের ট্র্যাজিক আখ্যান নয়। যে কোন শিল্প সৃষ্টির প্রধানতম শর্ত এ কাহিনী। আসলে,সৃষ্টির সঙ্গে নৈৰ্জন্য বা আলোকিত অনালোকিতের একটা সম্পর্ক আছে।যে বীজ মাটিতে প্রোথিত-সে কিন্তু কোলাহল থেকে সুদূর নিজের বিশেষ এক পরিবেশে অঙ্কুরিত হয়ে উঠতে চায়। এই পরিবেশে বাইরের আলো বা কোলাহল যখন প্রবেশ করে সৃষ্টির পরিবেশ সেই মুহূর্তে না পালিয়ে থাকতে পারে না। আর তখনই ঘটে সূত্রধর বা শিল্পীর প্রস্থান।
সূত্রধর বা শিল্পী কিন্তু কোলাহলময় জগতের বাসিন্দা। এই জগতের আলো-হাওয়ায় তাঁর বেঁচে থাকা। কিন্তু বেঁচে থাকলে কি হবে, গোটা জগৎকে শোষণ করে গড়ে উঠছে তাঁর একলা মানুষের মন। এ মন তাঁর একার। এই একাকীত্ব এক সময় বিশেষ পরিবেশে গড়ে তোলে আর এক জগৎ। এই গড়ে তোলা জগতের সুখ-দুঃখ আনন্দ-বিষাদ খুঁটিনাটি যাকিছু সবই তাঁর নিজের তৈরি। সে একাগ্রচিত্তে এসব বানায় বা গড়ে। এই নির্মাণকাল বা মুহূর্তটুকুতে সে কিন্তু সমস্ত কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। সংসার থেকে সম্পূর্ণ সরে গিয়ে তাঁর এই নির্মাণকালটুকু আমাদের এই চেনা-জানা পৃথিবীর বাইরে ভিন্ন কোন গ্রহে অপরিচিত এক নক্ষত্রের আলোয় উদ্ভাসিত। সেখানে সে কেবল একা।
বৈশাখ মাসের এক পূর্ণিমার রাতে গৌতমের তত্ত্ববোধ হল । এই তত্ত্ব,বলাবাহুল্য,চারটি আর্যসত্য এবং তদন্তর্গত অষ্টাঙ্গিক মার্গ। কিন্তু তত্ত্ববোধ হওয়ার পরও ভগবান বুদ্ধ ওই বোধিবৃক্ষের তলে সাতদিন বসে রইলেন। এই বসে থাকার কালেই তাঁর মনে এসেছিল গভীর প্রতীত্য-সমুৎপাদ। আর্যসত্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ ও প্রতীত্য-সমুৎপাদ সবই কিন্তু কোলাহল থেকে দূর কোন এক বিশেষ নৈৰ্জন্যে প্রস্তুত। এমন নির্মাণ মুহূর্তে কেউ নেই,কিছুই ছিল না। তার পূর্বে মার পালিয়েছে বহুদূর। বৃক্ষের তলায় একলা বুদ্ধ রচনা করেছেন আর এক জগৎ। রাত্রির রূপে তার মন নেই, মন চলে গেছে ভিন্ন এক আলোকিত অনালোকে। এবং পরিস্থিতির পরিবেশ গড়ে তুলতে সহায়ক ছিল নৈর্জন্য।
সূত্রধর বা বিশ্বকর্মা রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর নিকট সময় নিয়েছিলেন মাত্র একুশ দিন। দুইনো দুর্গের নির্জনতায় জর্মন কবি রিলকে কাটিয়েছিলেন 1911 অক্টোবর থেকে 1912 ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তাঁর লিখনের ইংরেজি অনুবাদক লিসম্যানের ভাষায়" লং পিরিয়ড অফ কন্সেন্ট্রেশন" থেকে পাওয়া দুইনো এলিজির কবিতাগুলি। এরকম বহু উদাহরণ আনা যায়,যে সব লিখনের পেছনে একটা নৈর্জন্যের ইতিহাস থেকে গেছে।
নৈর্জন্য এবং আলোকিত অনালোকে ভ্রূণের মত বেড়ে ওঠে শিল্পীর সাধনা। আর তারপরই ঘটে প্রসব। কিন্তু এই প্রসব সামাজিক কান্ড। শিল্পী সমাজের মানুষ। সামাজিক জীব যেমন সব কিছু গ্রহণ বর্জন করে বেঁচে থাকে শিল্পীও তাই। মনে রাখতে হবে, এ প্রসব সদ্যজাত সন্তানের মত। মানবশিশুকে যেমন বিশেষ কোনো অর্থ বা বন্ধন এর মধ্যে আবদ্ধ রাখা যায় না,তেমনি শিল্পীর শিল্পটিকেও নির্দিষ্ট বাটখারায় ওজন চলে না।এ সৃষ্টি বহুত্ব সহাবস্থানের আগ্রহী। অজস্র পাঠ প্রসঙ্গ এখানে মেলে। এক কথায় বলা যায় বহুস্বরিক।
কিন্তু কেন বহুস্বরিক? আজকের মনোবিজ্ঞান বলে, মানুষ কোন বিচ্ছিন্ন একক নয়। মুহুর্তের মধ্যে এক অবস্থা থেকে ভিন্ন অবস্থায় তার যাতায়াত অবিরল। তার মনের মধ্যে একসঙ্গে সহাবস্থান করে বিজ্ঞান, ইতিহাস, রাষ্ট্র, অর্থ, অঙ্ক,সমাজ শিল্প ইত্যাদি। তাই এসবের ছায়া পড়বেই মানব রচিত শিল্পে। বুদ্ধদেবের আর্য সত্য অষ্টাঙ্গিকমার্গ বা প্রতীত্য-সমুৎপাদ এর বাইরে নেই। অতি ক্ষুদ্র একটি কবিতা কিংবা সামান্য একটি ছবিও তাই। নৈর্জন্যে জাত এসব লিখন বা আঁক অবশ্যই বহুস্বরিক। যেকোনো পাঠক নানা কালে এর মধ্যে ভিন্ন প্রসঙ্গ খুঁজে নেবেন।
অজস্র প্রসঙ্গের ভিড়ে কল কল করে ওঠা এই শিল্প কিন্তু নৈঃশ্যব্দময়। যেন সমুদ্র ও পাড়ের উত্তাল ঝাউমর্মরের ভেতর তন্ময়তা পাওয়া। যেন অনেক ঘটনার ভিড়ে নৈর্জন্য হয়ে নৈঃশব্দ্য প্রাপ্তি। যেকোনো শিল্প এই নৈঃশব্দ্য কামনা করে। এ নৈঃশব্দ্য আলোর অস্তিত্বহীন নিকষ অন্ধকার নয়। নয় পত্রালির গা বেয়ে নিছক বারিধারা ফোঁটা ফোঁটা গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য। এ নৈঃশব্দ্য ঘোষণাহীন কর্মতৎপরতায় অন্তর্লীন এক স্বাভাবিকতা। রাজগৃহের আম্রকাননে একবার সহস্র শিষ্যসহ অবস্থান করছেন বুদ্ধ। বৌদ্ধবিদ্বেষী অজাতশত্রুকে সেই আমের বনে রাত্রিকালে নিয়ে চলেছেন জীবক। জ্যোৎস্না লুটানো বনের পথ ধরে এগিয়ে আসছেন তারা। কিন্তু অনন্ত নিস্তব্ধতা ছাড়া অন্য কোনো সঙ্গী নেই। একসময় ভয়ে অজাতশত্রু বলে উঠলেন; যেখানে সহস্র শিষ্য নিয়ে বুদ্ধ বাস করছেন,সেখানে সামান্য, হাঁচি-কাশির শব্দটুকু তো স্বাভাবিক। তুমি আমায় কোথায় নিয়ে চলেছে জীবক! আসলে এ নৈঃশব্দ্য এক আত্মমগ্ন ধ্বনির অনুভব। এই অনুভব পাঠকের। দৃশ্যমান শ্রমসাধ্য অথচ পদচিহ্নহীন সঞ্চারিত শিল্পটিকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখা। অথবা কোলাহলময় পাঠ পেরিয়ে রূপরিক্ততার মুখোমুখি হওয়া। যেন গভীর বনপথে লোকপ্রসিদ্ধ মর্মরিত ধ্বনিটিকে হঠাৎ আবিষ্কারের মধ্যে পাঠকের জেগে ওঠা।
"হাওয়া উঠল শেষরাতে, শব্দ করে খুলেগেল কপাট জানালা।
খোলা ঘর ফেলে রেখে বেরিয়ে এলাম আমি-ওই খালি ঘর।
এই শূন্য আকাশ।উষা উঠছে সবে,দুটো একটা তারা ডুবছে।
আমি খুলে ফেলেছি শিরা স্নায়ুর পাশ; ক্ষয়কাশ আমার বাবার।
পিতামহীর থেকে গ্রহণী আমার, প্রবৃদ্ধ পিতামহের অপস্মার।
রুগন আমি, দাও আমাকে শুইয়ে দাও মাটির ওপর,হালের নিচে।
নমস্কার লিঙ্গ, নমস্কার লাঙ্গল, তোমাকে প্রণাম হে যুগনদ্ধ দেবতা।
তোমাকে প্রণাম হে বীরর্ষভ, তোমাকে প্রণাম হে বিরুৎ।
কতরাত্রির রোগ যে আমার, অনাময় আমার এই ভোররাতে।"
( শম: বীতশোক ভট্টাচার্য)
এ কবিতা পাঠের পর ভোর-রাতের প্রার্থনা কখন যে নৈঃশব্দ্যে চারিয়ে গেছে পাঠক তা আবিষ্কার করবেন হয়তো। স্বীকারোক্তি থেকে প্রার্থনা হয়ে তা চলে গেছে। যেন জেন সাধকের লেখা কবিতা। এ কবিতা কোলাহলময় জীবন থেকে উঠে এসেছে। কোলাহল থেকে নৈঃশব্দ্যের দিকে তার যাত্রা। এই চলন স্বনির্ভর এবং উজ্জীবন। ধাপের পর ধাপ পেরিয়ে বুদ্ধির অতীত এমন এক জাগরণকে খুঁজে পাওয়া। আর তখনই পাঠক বা শ্রোতার ঘটে জন্মান্তর। এই জন্মান্তর পূর্ণতাকে আবিষ্কারের আনন্দ। যেন উপদেশ দেওয়ার পরিবর্তে শ্রাবকদের সম্মুখে বুদ্ধের হাতে তুলে ধরা প্রস্ফুটিত পুণ্ডরীক। মগ্ন পাট থেকে পাঠকের প্রশান্ত অর্জন পৌঁছে দেয় নৈঃশব্দ্যে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-
অজানার পরিচয় আছিল নিহিত
বাক্যে তার বাক্যের অতীত।
অনেক
উত্তরমুছুনদিন পরে আবার পুনরুজ্জীবিত হলাম।