মঙ্গলবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২০

ধ্রুপদি গদ্য-তিন

 এ সংসারের দিকে একজন ভাবুকের ভাব নিয়ে তাকালে,অনেকটা যেন বিহ্ব্ল হয়ে যেতে হয়,  দেখা যাবে--
কে এক দার্শনিক যেন এই 'হেলাফেলা সারাবেলা'-র মধ্যে তাঁর কথা বলে যাচ্ছেন,  এবং অতি তুচ্ছ অতি-সাধারণ কাজকর্মের মধ্যে থাকা,আমরা যাদের বলি, সংসারী, তারা সেই দার্শনিকের সুরে বাঁধা অত্যাশ্চর্য সব বাক্য উচ্চারণ করছে। অথচ, জানেইনা তারা--- কি বললাম, কি এর গভীরতা, এর অন্তর্নিহিত অর্থ কত নিবিড়ে মানুষের জীবন ধর্মে পৌঁছাতে চায়।

-- চায়, কিন্তু পারে?  না, তা পারে না।
পারবে কেমন করে! এখানে যে 'মহাজন' ছাড়া কারোও বাক্যের স্বীকৃতি সংসার দেয় না, তুচ্ছজন, সেও অমৃতের পুত্র হলেও, সেও এই পৃথিবীর তথা মহাবিশ্বের অনন্ত রাগিণীর সঙ্গে একই সূত্রে গাঁথা হলেও, বলবে না কেউ---
 কথাটা তো আবিষ্কার করল আমার নিত্য-আমি-কে! এই কথা তো আমার,তোমার মুখ থেকে উচ্চারিত হলেও-বা।

 এখানে 'তুমি' এবং 'আমি', একজন বক্তা অন্যজন শ্রোতা।
বক্তা তার ব্যক্তিগত গহন কোনো নিভৃতি থেকে বলেছে একটি কথা;শ্রোতা যে শুনেছে, সেও সেই অনাবিষ্কৃত-ব্যাক্তি সত্তার কি যেন এক সুরেলা মর্মরে আপনকরে নিয়েছে তা-কে।--- একে যদি মাধ্যম বলি,তবে তা হবে একটা পরিত্রান মাত্র, কারণ,মানুষের মন একটা যাহোক কিছু, মীমাংসা ছাড়া ভাসতে পারে না শুন্যে। পরিত্রান চাই, সস্তি চাই,চাই দিশা যেখানে একটু থেমে-থাকা যায় কুহেলির মধ্যেও।
 যদি, ম্যাথু আর্নল্ড এর কথা: মানুষ বিচ্ছিন্ন পরস্পর থেকে এক একটি দ্বীপের বাসিন্দা, একে দৃঢ় বিশ্বাস করে বসি; তাহলে তো একজনের কথা আর অন্যের হওয়ার উপায় বা সেতু থাকেনা।

অথচ 'সেতু' যা এই নিত্য দিনের নিত্যকালের হেলাফেলা সারাবেলা-র সংসার কোন সেই রাগিনীতে বেঁধে দেয় যেন।অতিতুচ্ছ সংসার এক একটি সত্য,করে উচ্চারণ,মহাজনের না-হলেও, তা যেন সত্য এবং অবশ্য পালনীয় অমোঘ।

 কারণ,যে কথাটি উচ্চারিত হয় আর বক্তা সাংসারিক বিচারে তুচ্ছ নগণ্য হলেও, সে এই মহাবিশ্বের গানের সভায় একজন রসিক। তার উচ্চারণে আছে কিছু যা তার গুনে- স্বরগ্রামে বাজে এবং যে শোনে তার ব্যক্তিগত তারে ঝংকৃত হয়ে তা এক সম্পূর্ণতার দিকে ধায়, পরস্পর ভিন্ন অনুভূতি সত্ত্বেও,বিচ্ছেদের মধ্যে একটি যে মিলন, এ সংসার চলছে তারই রাগিনীতে।

 প্রশ্ন- ব্যক্তিত্ব নিয়ে। ব্যক্তিত্ব স্বীকৃত হয় হয় প্রজ্ঞায়।প্রজ্ঞাও স্বীকৃতি ছাড়া মান্যতা পায় না।অবশ্য তুল্য মূল্য বিচার করতে গেলে একটু বিস্তৃততর প্রেক্ষাপটে পড়ে যেতে হয়।সংশয় জাগে--- কার জন্য কে স্বীকৃত হয়ে মান্যতা পেলেন। যাঁর জন্যে, যাঁর স্বীকৃতির জোরে যিনি শুধু স্বীকৃতি পেলেন, সেই দুই মহত্বের মধ্যে মুখ্য তো তাঁরই হওয়ার কথা।অর্থাৎ যিনি প্রতিজ্ঞাকে সাধারণের গন্ডি থেকে অবগুন্ঠিত রত্নটিকে সংসার-সমাজ এবং কাল থেকে মহাকালের তৃষিত-আধারে রাখলেন অর্ঘ্য হিসেবে।
 যেমন, কালিদাস, রাজা বিক্রমাদিত্যর খ্যাতিপ্রতিষ্ঠা-স্বীকৃতি ও মহানুভবতা কিছুই কম ছিলনা। তিনি এই হেলাফেলা সারাবেলার সংসার থেকে তুলে আনলেন এই সর্বকালের মহাকবিকে।  বিক্রমাদিত্যের কথা, ধ্বনি, রাগিনী যেন ভেসে গেল আপন সৃষ্ট কবিদেবতার সুরে।

 অথচ,কী আশ্চর্য কী আশ্চর্য ---সংসারের দিকে বা চলমান মানব জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখি,কত কত অখ্যাত অস্বীকৃত প্রাণ,যারা খায়-দায় ঘুমায়, বাজারকরে, দুঃখ-দুর্দশায় কাতর হয়, কখনো খুশি কখনো উল্লসিত হয়, একদিন মরেও যায়, তারা, হয়তো জ্ঞাতে বা অচেতনে এমন সব কথা বলে যা মহাকাব্যের তুল্য না-হলেও,অনেকটাই মূল্যবান। না, উধৃতি সহকারে নয়, এসব কথা তাদের ব্যক্তিগত সত্তার মধ্য থেকে ক্ষণিক উচ্চারণ।
 যেন মনেহয়--- সমগ্র জীবনের কোনো এক নিভৃত প্রকোষ্ঠে বিশাল এক জাগতিক ও মহাজাগতিক সত্য জমা হয়ে আছে, সেখান থেকেই আকস্মিক বিদ্যুতপাতের মতো তা ঠিকরে বেরিয়ে এসে ঝলকিত হয়ে---
মিলিয়ে যায়!
 আর কোনদিন পুনরুচ্চারিত হয় না!- মনে বা স্মরণে থাকে না তার, কেমন করেই-বা থাকবে; সে তো টেরই পায় না, যে কথাটি তার নিত্যজীবনেরর প্রবাহমান ধারার মধ্যে কোন মুহূর্তে অদৃশ্য এক কালপুরুষ তাকে দিয়ে কি কথা বলিয়ে নিয়েছে,

 তার মন তার সত্তা তার আকাশ ভরে বজ্র মানিক দিয়ে গাঁথা সব মহাজনের বাণী।  সেখানে তার নিজেরও ঢুকবার রন্ধ্র নেই কোনও।
 একমাত্র,নিজের সঙ্গে নিজে যখন কথা বলে সে অনুচ্চারে তখনই সেই বিরল একান্তে তার ভিতরের আগন্তুক আপন হতে বাইরে দাঁড়িয়ে এমন কিছু কথা বলে যায় তার সঙ্গে, যার ভাষা নেই অথবা থাকলেও তা দুর্বোধ্য, কেউ শোনে না সেই কথা, জানে নাও কেউ।

 যদি কোন তাপিত পীড়িত লাঞ্ছিত অনাথ বলে: ভালো লাগে না আর, এবার মরলে বাঁচি!-- কে গ্রাহ্য করবে।
 অথচ, মৃত্যু এবং বাঁচা, এই দুটি বিপরীতার্থক কথা, এর মধ্যে যেমন জীবনের যাতনা আছে, যা সংসারের হিসাব বহির্ভূত অর্থাৎ, সংসার তার জীবনের দাপটে,আকাঙ্ক্ষায়, মায়া-মমতায় ছলনায় প্রতিমূহুর্তে অস্থির, আবার ওই অনাথ ও মরে 'বাঁচতে' চায়।তার তাৎপর্য কী এই দাঁড়ায় না যে বাঁচাটা স্বতঃসিদ্ধ?

 এই তুচ্ছ অনাথের জগৎ সত্যের মূল ধর্মটি মহাজন' বা দার্শনিক না হয়েও,উচ্চারণটি হেলাফেলা সারাবেলার ধ্বনিপুঞ্জে কম্পিত হয়েও দর্শক বা শ্রোতাবিহীন সংসার নাট্যমঞ্চে সংলাপিত।
 তবু,তার উপায় নেই মহাবিশ্বের নিরন্তরের কম্পনজাল থেকে বেরিয়ে আসবার।
                         ____________________
উপরোক্ত ছবি দুটি নারায়ণ মুখোপাধ্যায় এর আঁকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ধ্রুপদি গদ্য -চার

 নীলাচলে জগন্নাথদেবের বিগ্রহ নিয়ে একটি কাহিনী আছে।  সমুদ্রে ভেসে এসেছিল ব্রহ্মদারু রূপে কৃষ্ণের নাভি।  রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দৈববা...