তবে প্রশ্ন হতে পারে,আনন্দ কাকে বলব? বলাই বাহুল্য, সরাসরি এ প্রশ্নের উত্তর নেই | আনন্দ হল আনন্দই-আর কিছুই নয় | তার কোনো বিকল্প নেই,তাই সে নির্বিকল্প- ব্রহ্মের মত | প্রকৃতই, ব্রহ্ম তো আনন্দস্বরূপ | অর্থাৎ আনন্দ ব্রহ্মই | কবিতাও এতএব ব্রহ্মই |
ব্রহ্ম হলেন অস্তিত্বের পরম কারণ! সবকিছুই যেহেতু তাঁর অন্তর্গত,এমনকি প্রতিটি শব্দও যেহেতু তাঁরই প্রকাশ,তাই কোন শব্দগুচ্ছ দিয়েই তাকে প্রকাশ করা যায় না | অংশ কিভাবে পূর্ণ কে প্রকাশ করবে? তাই ব্রহ্ম,তথা আনন্দ তথা কবিতাকেও কোন সংজ্ঞার দ্বারাই নিশ্চিত রূপে বাঁধা -যায়না |
আনন্দ শব্দটি কিন্তু আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহারে আমাদের কাছে অতি পরিচিত | যদিও আমাদের বস্তুসর্বস্ব জীবনে তার সাক্ষাৎ কদাচিৎ মেলে,তবু আনন্দ শব্দটি আমাদের কাছে সম্ভবত: সুখেরই সমার্থক হয়ে উঠেছে | বস্তু বা বিষয় আমাদের যে তাৎক্ষণিক তৃপ্তি দিতে পারে, সুখ তারই একটা সমার্থক; একটি ক্ষণিক সুখের তৃপ্তি শেষ হয়ে গেলেই তখন আবার এমন একটা নতুন সুখের সন্ধান, তারপর আবার...অন্তহীন এই অতৃপ্তি থেকে অতৃপ্তিতেই লাফিয়ে চলা যেন জীবনের ভবিতব্য | সুতরাং আনন্দ কাকে বলে আমরা এই প্রবহমান বৈষয়িকতার মধ্যে তা জানতে পারি না | অথচ 'আনন্দ' শব্দটির গঠনের মধ্যেও তার কোনো আভাস খুঁজে পাওয়া কঠিন | বৈশেষিক দর্শনকার ঋষি কণাদ তাঁর দ্বিতীয় সূত্রে ধর্মের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন,যার দ্বারা নি:শ্রেয়স লাভ হয়,তাই ধর্ম | আপাতত ধর্ম নয়,আমার আগ্রহ ওই নি:শ্রেয়স শব্দটির প্রতি | অর্থাৎ এমন একটা অবস্থার চেয়ে শ্রেয় আর কিছুই নেই অর্থাৎ আনন্দই, কিন্তু একটু পরোক্ষভাবে বলা হল যাতে আমরা ধারণা করতে পারি | আমরা শুধু যা যা শ্রেয় নয় তাই চিনি, সুতরাং বলা হল, নি:শ্রেয়স এমন একটা অবস্থা যা আমাদের চেনা প্রতিটি অবস্থার চেয়ে শ্রেয় | অর্থাৎ আনন্দ, যা কবিতার কাছ থেকে আমি চিরকাল আশা করেছি, আজও করি | আর,পাঠকও কবিতার কাছে তাই পেতে পারেন |
মনে হতে পারে কবিতার কথা বলতে গিয়ে আনন্দ প্রসঙ্গে এত কথা কেন? কারণ, আনন্দ আর সুখের মধ্যে-এই পার্থক্যটা না বোঝাতে পারলে কবিতার কাছে আমাদের কি চাওয়ার আছে আর তার কাছে আমরা যা চাচ্ছি,তার পার্থক্যটা স্পষ্ট হবে না | প্রকৃতপক্ষে ঠিক এই মুহূর্তে পার্থক্যটা বিপুল এবং এটা একটা দুর্ভাগ্যজনক সত্য যে, কবিতা আমাদের যা দিতে পারে তা মহত্তম; কিন্তু তার কাছে আমরা অতিতুচ্ছ, যৎকিঞ্চিৎকর কিছু কামনা নিয়ে ভিক্ষা পাত্র মেলে ধরেছি | আমরা চাই চালাকি,স্মার্টনেস, পল্লবগ্রাহিতা-সে আমাদের গভীরতা দিতে পারে,আমরা চাই উত্তেজনা-সে আমাদের প্রশান্তি দিতে পারে,আমরা চাই যৌনতা,সে আমাদের প্রেম দিতে পারে,আমরা চাই অতিকথন-সে আমাদের মৌনতা দিতে পারে,আমরা চাই অকবিতা-সে আমাদের কবিতা দিতে পারে | আমরা কি চাচ্ছি তার ওপরই নির্ভর করে কবিতার বর্তমান,আর ভবিষ্যৎও |
এখন আমাদেরই,অর্থাৎ বাংলা কবিতার পাঠক এবং লেখকদেরও ঠিক করতে হবে,আমরা সত্যিই কি চাই | কিন্তু সমস্যা হচ্ছে,সে ব্যাপারটাও নির্ভর করছে সমসাময়িক হুজুগের ওপরে, বাজারের ওপরে | মানুষ বাজার যতটা নিয়ন্ত্রণ করে,বাজার মানুষ কে নিয়ন্ত্রণ করে তার চাইতেও বেশি| কোন কবিতা টা সত্যিই ভালো সে সম্পর্কে স্বাধীন কোন মতামত গঠন করা একজন ব্যক্তি পাঠকের কাছে সহজ নয়| কোন খাবারটা ভালো এটা বিজ্ঞাপন সংস্থা বলে না দিলে আমরা যেমন বুঝতে পারি না,তেমনি কবিতাও পড়ে আমরা বুঝতে পারি না-সেটা ভাল না মন্দ | আমাদের কোন বুদ্ধিজীবী কিংবা বাজার সমীক্ষার ওপর নির্ভর করতে হয় মতামত গঠনের জন্য | রসগোল্লা আর থার্মোকল কোনটা খেতে বেশি ভালো,এটা জানার জন্য আজ বাংলার পাঠকদের বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয় |
এটা দুঃখের,কিন্তু অনিবার্য নয় | কবিতা পাঠ করুন আনন্দের জন্য,এবং এটাও স্থির জানুন যে,আপনার ভালো লাগার খবর একমাত্র আপনি জানেন; সে খবর কেউ আপনাকে দিতে পারে না | কোন বিশেষজ্ঞ নয়,কোন সমীক্ষা নয় | কোন দাদাও নয় | আপনার রসনা তৃপ্তির জন্য রসগোল্লা ছেড়ে কারো পরামর্শেই থার্মোকল বেছে নেবেন না | নিজের ভাললাগার ওপর,নিজের আস্বাদনের ওপর আস্থা রাখুন | কবিতা পড়ুন আনন্দের জন্য,পন্ডিত হবার জন্য নয়,বুদ্ধিজীবী হবার জন্য নয় | কি পড়লে বুদ্ধিজীবী মহলে প্রশংসিত হবেন সেটা গৌণ,আনন্দই আসল কথা | যা গভীর,তাই আপনাকে সত্যি কারের আনন্দের সন্ধান দিতে পারে | স্মার্টনেস নয়,সম্প্রতিকতা নয়,চাতুর্য নয়,গভীরতাই কবিতার একমাত্র ঐশ্বর্য |
কবিতার কাছে গভীরতা আশা করুন | আপনার আশাই বাংলা কবিতার আশার আলো হয়ে উঠতে পারে | যা অগভীর,তা কিছুকাল সমস্ত পাঠক কে বোকা বানাতে পারে,চিরকাল সমস্ত পাঠক কে বোকা বানাতে পারে,কিন্তু চিরকাল সমস্ত মানুষকে বোকা বানাতে পারে না | ফলত:, যা অগভীর,যা চাতুর্য আর চালাকি থেকে উদ্ভূত,তা একসময় মুছে যায় | বাংলা কবিতাকে চালাকি আর চাতুর্য থেকে মুক্ত করুন, সে সম্পূর্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আগেই,হয়তো ইতিমধ্যেই দেরি কিছুটা হয়েছে | কারণ চালাকির প্রতি আমাদের যে স্বাভাবিক আকর্ষণ,তা তো আর মিথ্যা নয় | এ আকর্ষণ আছে বলেই তো স্বামী বিবেকানন্দ কতকাল আগেই সাবধান করেছিলেন, 'চালাকির দ্বারা মহৎ কাজ হয় না' | তবু চালাকির দ্বারা মহৎ কাজ করার সে চেষ্টা আজও অব্যাহত আছে | আবার বলি চালাকি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে না | কিন্তু তবু একদিকে যেমন কবিতার নামে বিপুল পরিমাণ চালাকি মুছে যাচ্ছে,অন্যদিকে আবার কবিতার নামে চালাকি নিবেদিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত | ফলে চালাকির এই অবাঞ্ছিত ভিড় পাঠককে ক্লান্ত করছে- এও সত্য | তবু, পরিশেষে আবার বলি,অবস্থাটা বদলাচ্ছে | বিগত কয়েক দশকে অনেকটাই বদলেছে,এবং ভালোর দিকেই | বহু প্রতিভাবান তরুণ কবির অক্লান্ত চেষ্টায় চালাকি নয়,উঠে আসছে প্রকৃত কবিতা-যা গভীর,আনন্দময়,সুন্দর | তাদের লেখা পড়ুন এবং নতুন যুগের বাংলা কবিতাকে চিনুন, আনন্দ লাভ করুন |
স্বভাবনায় লেখা স্বচ্ছ্ল গদ্য। আনন্দ পেলাম।
উত্তরমুছুনস্বভাবনায় লেখা স্বচ্ছ্ল গদ্য। আনন্দ পেলাম।
উত্তরমুছুনপ্রয়োজনীয় লেখা।
উত্তরমুছুনসমৃদ্ধ হলাম
উত্তরমুছুন