মঙ্গলবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২০

ধ্রুপদি গদ্য-তিন

 এ সংসারের দিকে একজন ভাবুকের ভাব নিয়ে তাকালে,অনেকটা যেন বিহ্ব্ল হয়ে যেতে হয়,  দেখা যাবে--
কে এক দার্শনিক যেন এই 'হেলাফেলা সারাবেলা'-র মধ্যে তাঁর কথা বলে যাচ্ছেন,  এবং অতি তুচ্ছ অতি-সাধারণ কাজকর্মের মধ্যে থাকা,আমরা যাদের বলি, সংসারী, তারা সেই দার্শনিকের সুরে বাঁধা অত্যাশ্চর্য সব বাক্য উচ্চারণ করছে। অথচ, জানেইনা তারা--- কি বললাম, কি এর গভীরতা, এর অন্তর্নিহিত অর্থ কত নিবিড়ে মানুষের জীবন ধর্মে পৌঁছাতে চায়।

-- চায়, কিন্তু পারে?  না, তা পারে না।
পারবে কেমন করে! এখানে যে 'মহাজন' ছাড়া কারোও বাক্যের স্বীকৃতি সংসার দেয় না, তুচ্ছজন, সেও অমৃতের পুত্র হলেও, সেও এই পৃথিবীর তথা মহাবিশ্বের অনন্ত রাগিণীর সঙ্গে একই সূত্রে গাঁথা হলেও, বলবে না কেউ---
 কথাটা তো আবিষ্কার করল আমার নিত্য-আমি-কে! এই কথা তো আমার,তোমার মুখ থেকে উচ্চারিত হলেও-বা।

 এখানে 'তুমি' এবং 'আমি', একজন বক্তা অন্যজন শ্রোতা।
বক্তা তার ব্যক্তিগত গহন কোনো নিভৃতি থেকে বলেছে একটি কথা;শ্রোতা যে শুনেছে, সেও সেই অনাবিষ্কৃত-ব্যাক্তি সত্তার কি যেন এক সুরেলা মর্মরে আপনকরে নিয়েছে তা-কে।--- একে যদি মাধ্যম বলি,তবে তা হবে একটা পরিত্রান মাত্র, কারণ,মানুষের মন একটা যাহোক কিছু, মীমাংসা ছাড়া ভাসতে পারে না শুন্যে। পরিত্রান চাই, সস্তি চাই,চাই দিশা যেখানে একটু থেমে-থাকা যায় কুহেলির মধ্যেও।
 যদি, ম্যাথু আর্নল্ড এর কথা: মানুষ বিচ্ছিন্ন পরস্পর থেকে এক একটি দ্বীপের বাসিন্দা, একে দৃঢ় বিশ্বাস করে বসি; তাহলে তো একজনের কথা আর অন্যের হওয়ার উপায় বা সেতু থাকেনা।

অথচ 'সেতু' যা এই নিত্য দিনের নিত্যকালের হেলাফেলা সারাবেলা-র সংসার কোন সেই রাগিনীতে বেঁধে দেয় যেন।অতিতুচ্ছ সংসার এক একটি সত্য,করে উচ্চারণ,মহাজনের না-হলেও, তা যেন সত্য এবং অবশ্য পালনীয় অমোঘ।

 কারণ,যে কথাটি উচ্চারিত হয় আর বক্তা সাংসারিক বিচারে তুচ্ছ নগণ্য হলেও, সে এই মহাবিশ্বের গানের সভায় একজন রসিক। তার উচ্চারণে আছে কিছু যা তার গুনে- স্বরগ্রামে বাজে এবং যে শোনে তার ব্যক্তিগত তারে ঝংকৃত হয়ে তা এক সম্পূর্ণতার দিকে ধায়, পরস্পর ভিন্ন অনুভূতি সত্ত্বেও,বিচ্ছেদের মধ্যে একটি যে মিলন, এ সংসার চলছে তারই রাগিনীতে।

 প্রশ্ন- ব্যক্তিত্ব নিয়ে। ব্যক্তিত্ব স্বীকৃত হয় হয় প্রজ্ঞায়।প্রজ্ঞাও স্বীকৃতি ছাড়া মান্যতা পায় না।অবশ্য তুল্য মূল্য বিচার করতে গেলে একটু বিস্তৃততর প্রেক্ষাপটে পড়ে যেতে হয়।সংশয় জাগে--- কার জন্য কে স্বীকৃত হয়ে মান্যতা পেলেন। যাঁর জন্যে, যাঁর স্বীকৃতির জোরে যিনি শুধু স্বীকৃতি পেলেন, সেই দুই মহত্বের মধ্যে মুখ্য তো তাঁরই হওয়ার কথা।অর্থাৎ যিনি প্রতিজ্ঞাকে সাধারণের গন্ডি থেকে অবগুন্ঠিত রত্নটিকে সংসার-সমাজ এবং কাল থেকে মহাকালের তৃষিত-আধারে রাখলেন অর্ঘ্য হিসেবে।
 যেমন, কালিদাস, রাজা বিক্রমাদিত্যর খ্যাতিপ্রতিষ্ঠা-স্বীকৃতি ও মহানুভবতা কিছুই কম ছিলনা। তিনি এই হেলাফেলা সারাবেলার সংসার থেকে তুলে আনলেন এই সর্বকালের মহাকবিকে।  বিক্রমাদিত্যের কথা, ধ্বনি, রাগিনী যেন ভেসে গেল আপন সৃষ্ট কবিদেবতার সুরে।

 অথচ,কী আশ্চর্য কী আশ্চর্য ---সংসারের দিকে বা চলমান মানব জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখি,কত কত অখ্যাত অস্বীকৃত প্রাণ,যারা খায়-দায় ঘুমায়, বাজারকরে, দুঃখ-দুর্দশায় কাতর হয়, কখনো খুশি কখনো উল্লসিত হয়, একদিন মরেও যায়, তারা, হয়তো জ্ঞাতে বা অচেতনে এমন সব কথা বলে যা মহাকাব্যের তুল্য না-হলেও,অনেকটাই মূল্যবান। না, উধৃতি সহকারে নয়, এসব কথা তাদের ব্যক্তিগত সত্তার মধ্য থেকে ক্ষণিক উচ্চারণ।
 যেন মনেহয়--- সমগ্র জীবনের কোনো এক নিভৃত প্রকোষ্ঠে বিশাল এক জাগতিক ও মহাজাগতিক সত্য জমা হয়ে আছে, সেখান থেকেই আকস্মিক বিদ্যুতপাতের মতো তা ঠিকরে বেরিয়ে এসে ঝলকিত হয়ে---
মিলিয়ে যায়!
 আর কোনদিন পুনরুচ্চারিত হয় না!- মনে বা স্মরণে থাকে না তার, কেমন করেই-বা থাকবে; সে তো টেরই পায় না, যে কথাটি তার নিত্যজীবনেরর প্রবাহমান ধারার মধ্যে কোন মুহূর্তে অদৃশ্য এক কালপুরুষ তাকে দিয়ে কি কথা বলিয়ে নিয়েছে,

 তার মন তার সত্তা তার আকাশ ভরে বজ্র মানিক দিয়ে গাঁথা সব মহাজনের বাণী।  সেখানে তার নিজেরও ঢুকবার রন্ধ্র নেই কোনও।
 একমাত্র,নিজের সঙ্গে নিজে যখন কথা বলে সে অনুচ্চারে তখনই সেই বিরল একান্তে তার ভিতরের আগন্তুক আপন হতে বাইরে দাঁড়িয়ে এমন কিছু কথা বলে যায় তার সঙ্গে, যার ভাষা নেই অথবা থাকলেও তা দুর্বোধ্য, কেউ শোনে না সেই কথা, জানে নাও কেউ।

 যদি কোন তাপিত পীড়িত লাঞ্ছিত অনাথ বলে: ভালো লাগে না আর, এবার মরলে বাঁচি!-- কে গ্রাহ্য করবে।
 অথচ, মৃত্যু এবং বাঁচা, এই দুটি বিপরীতার্থক কথা, এর মধ্যে যেমন জীবনের যাতনা আছে, যা সংসারের হিসাব বহির্ভূত অর্থাৎ, সংসার তার জীবনের দাপটে,আকাঙ্ক্ষায়, মায়া-মমতায় ছলনায় প্রতিমূহুর্তে অস্থির, আবার ওই অনাথ ও মরে 'বাঁচতে' চায়।তার তাৎপর্য কী এই দাঁড়ায় না যে বাঁচাটা স্বতঃসিদ্ধ?

 এই তুচ্ছ অনাথের জগৎ সত্যের মূল ধর্মটি মহাজন' বা দার্শনিক না হয়েও,উচ্চারণটি হেলাফেলা সারাবেলার ধ্বনিপুঞ্জে কম্পিত হয়েও দর্শক বা শ্রোতাবিহীন সংসার নাট্যমঞ্চে সংলাপিত।
 তবু,তার উপায় নেই মহাবিশ্বের নিরন্তরের কম্পনজাল থেকে বেরিয়ে আসবার।
                         ____________________
উপরোক্ত ছবি দুটি নারায়ণ মুখোপাধ্যায় এর আঁকা।

বৃহস্পতিবার, ৮ অক্টোবর, ২০২০

ধ্রুপদি গদ্য- দুই

...  কথা হইতেছিল প্রায় কয়েক বৎসর পূর্বে একদিন, কবি আলোক সরকারের বৈঠকখানায় বসিয়া | কথা উঠিয়াছিল  কবির  নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত রবীন্দ্র পুরস্কারটি ফিরাইয়া দিবার প্রসঙ্গও | উঠিয়াছিল তাঁহার কাব্য-শরীরে কিন্তু, এতৎসত্ত্বেও,এ সকল ঘটনার তেমন-কোনো স্পষ্টলক্ষ্য উল্লেখ না থাকিবার প্রসঙ্গটিও | উঠিয়াছিল, ইহার পর, রবীন্দ্রনাথের ন্যায় একজন শুদ্ধতম কবিরও রচনাক্রমে, এই ধরনের সমসাময়িক প্রসঙ্গগুলির গভীর মুদ্রণচিহ্নের প্রসঙ্গটিও, অনিবার্যভাবেই |এইরূপ নানা প্রসঙ্গক্রমেই, কবি শেষ পর্যন্ত বলিয়াছিলেন সেই কথাটা, যাহা খুব নতুন কথা  কিছু নহে নিশ্চয়ই, কিন্তু যতবারই শুনি বা পড়ি কোথাও, ততবারই যেন আবার নূতন করিয়া একটা ধন্দেই পড়িয়া যাইতে হয় ফের | নূতন করিয়া প্রসঙ্গটা নিজের মত করিয়া বুঝিয়াই লইতে হয় আরও একবার | এই লেখাটা, সেই বুঝিয়া-লওয়ারই, একটা প্রক্রিয়া মাত্র---তাহার অধিক কিছু নহে |


...  কবি যাহা বলিয়াছিলেন সেদিন, তাহার একটা সংক্ষিপ্তসার হয়ত এইরূপ হইতে পারে, যে, রবীন্দ্রনাথের ন্যায় একজন মহাকবি--- সমসাময়িকের নানা ধুলাবালিই গায়ে মাখিতেই পারেন ইচ্ছামত--- যেহেতু তিনি একজন মহাকবিই | নানা ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতিই, তাঁহার বিরাট কাব্যদেহে, মানাইয়াই যায় তাই, একভাবে | কিন্তু একজন আধুনিক কবির পক্ষে--- তাহা একেবারে সর্বনাশের পথ হইবে--- কারণ নিজের মত করিয়া, একটা নাতিমহৎ সুন্দরকেই, তিনি নির্মাণ করিতে থাকেন তাঁহার সমস্ত জীবনের সাধনার দ্বারা | সেই সুন্দর,কোন অসহসহন সুন্দর নহে কোনোঅর্থেই |---তাহার স্পর্শকাতর' ত্বকে,কোনরূপ সমসাময়িকতা, কোনরকম ধুলাবালি--- তাই সহে না |


... পূর্বেই বলিয়াছি, যে আদৌ নুতন নহে কথাটা | আগেও অনেকবারই, এই ধরনের কথাবার্তা,আমরা শুনিয়াছি; পড়িয়াছিও নানা জায়গায় | কিন্তু পূর্বেও,যেমন বুঝিতে পারিনাই কিছুই; এ যাত্রাও তেমনই, বিশেষ-কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না যেন ঠিক | কি যে বলিতে চাহিতেছেন কবি, তাহা মোটামুটি অনুমান করিয়া লইতে হয়তো-বা পারিলাম একপ্রকার, কিন্তু তাহার সহিত কথাবার্তাটা আরো চালাইয়া গিয়া, তাঁহার এতদ্বিষয়ক মতামতটা আরও  সুস্পষ্ট করিয়া বুঝিয়া লইব যে, পরীক্ষা করিয়া লইব যে নানা দিক হইতে, এমন অবকাশ টুকুও আবার ছিল না ঠিক তন্মুহূর্তে | তাই মনের ভিতর একটা অস্বস্তি লইয়াই, একটা খটকা লইয়াই,  উঠিয়া পড়িতেই হইল সেদিন তাহার বাসা হইতে |


... 'বাসা' শব্দটা, এইখানে বলিয়া রাখা হয়ত ভালো হইবে, যে, খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করিলাম আমরা এইস্থলে , কোন অসংজ্ঞান পূর্ববঙ্গীয় প্রভাব বসত নহে | আধুনিক যে ফ্ল্যাটবাড়ি গুলিতে আমরা অনেকেই বসবাস করিতে বাধ্যই হই সম্প্রতি, সেগুলা বাড়ি তো নহে ঠিক আমাদের, বরং বাসাই--- যেন পক্ষীকোটরই--- এক প্রকারের | 'ফ্ল্যাট' শব্দটি যদিও বাঙ্গালাই হইয়া গিয়াছে ইদানিং, তবু 'বাসা' শব্দটি  তাহার পাশাপাশি যদি চলিয়া যায় ওই অর্থে,তাহা হইলে মন্দ কি !

...'আধুনিক কবি' শব্দবন্ধটিও, ঠিক যেভাবে চলিয়া গিয়াছে সম্প্রতি,বাঙ্গালাভাষায় | আদিতে,একটি ব্যাঙ্গার্থেই যদিও,প্রযুক্ত হইত শব্দটা | প্রয়োগ করিতেন, এই নূতন জিনিসটার বিরোধী ছিলেন যাঁহারা, মূলত তাঁহারাই | আজ অবশ্য, স্বপক্ষীয়- বিপক্ষীয়- নির্বিশেষে, প্রায় সকলেই,'আধুনিক কবি' হিসাবেই বর্ণনা করিয়া থাকেন আজিকালিকার এই আমাদিগের ন্যায় বঙ্গীয় কবিবংশ-অবতংসদিগকে | ফরাসীদেশে, 'ফোভিস্ট' শব্দটি যেমন সর্বপ্রথম প্রযুক্ত হইয়াছিল বিংশশতাব্দীর সূচনালগ্নে  সমুত্থিত এক বিশেষ শিল্পীগোষ্ঠীকে আক্রমণই করিবার উদ্দেশ্যে( কথাটির মূল অর্থ: বন্য পশুজাতীয়),  কিন্তু পরবর্তীকালে,  তাঁহারা মহানন্দে ওই শিরোপাটি নিজেরাই ব্যবহার করিতে শুরু করিলেন "আমায় বল্ল গর্ভস্রাব আর তাতেই আমার পরমাল্হাদ"---এই বাঙ্গালা  প্রবাদ বাক্যটিতে প্রদর্শিত পথেই; আমরাও, অনেকটা সেইরূপই, নিজেদের 'আধুনিক কবি'- পরিচয়টা লইয়া যথেষ্ট গর্ব-অনুভবই করিয়া থাকি  বোধহয় ইদানীংকালে | উহা যে আদতে একটা গালাগালিই মাত্র,  ইহা যেহেতু আমরা ভুলিয়া সারিয়াছি  আজ বহুদিন যাবৎ |


...  "গীতিকবি" বলিয়া একটা শব্দবন্ধ যদিও, ছিল পূর্বকালে, বাঙ্গালাভাষায় |যাহা দিয়া সেই শ্রেণীর কবি দিগকেই শুধু বুঝানো হইতনা, যাঁহারা সারাজীবন ধরিয়া কিছু গীতাখ্য রচনাই মাত্র প্রণয়ন করিয়াছেন বা করেন | বরং বুঝানো হইত সেই বিশেষ শ্রেণীর কবিকুলকেই,যাঁহারা আপন মনের ভাবটিকেই বিশেষ কোনো বস্তুভার ব্যতিরেকেই, মেলিয়া ধরেন আপনাদের কবিতায় | যে  কবিতা, হয়তো প্রচলিত অর্থে গীত হইবে না কোনদিনই |  ইংরেজি "লিরিক পয়েট" কথাটির এমন-একটা অসামান্য অনুবাদ ছিল ইহা, যাহা বস্তুত মূল শব্দবন্ধটা অপেক্ষাও,উৎকৃষ্টতর |এই মূল অর্থটি যদি মাথায় রাখিতে পারি আমরা,তাহা হইলে কবি জসীমউদ্দীনকে যেমন,তেমনই  কবি জীবনানন্দ দাশকেও, মূলত একজন গীতিকবিই বলিতে, আমাদের কোন আপত্তি হইবার কারণ থাকিবে না বোধহয় কোনপ্রকার | এমনকি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে বা বিষ্ণু দে-কেও | 'আধুনিক কবি', এই অপশব্দটার হাত হইতে, অনেকটা মুক্তিলাভ, হয়তো ঘটিতে পারিবে আমাদিগের সেক্ষেত্রে | 'গীতিকবি', এই শব্দটাকে, আপনার প্রাপ্য মর্যাদায় পুনর্জীবিত, পুনরধিষ্ঠিত যদি আমরা করিতে পারি কোনদিন, কোনভাবে |


... আলোকদার ঐ কথাটাকে, আমরা তাই এই ভাষাতেই অনুবাদ করিয়া লইতেছি আমাদের মত করিয়া, যে একজন মহাকবির যাহা সাজে, একজন গীতিকবির কিন্তু তাহা সাজে না কোনোভাবেই | আর আমরা কেহই যেহেতু মহাকবি নহি খুব সম্ভবত, বরং গীতিকবিই(সদ্য আলোচিত মূল অর্থে);সুতরাং একজন মহাকবির যাহা ধর্ম,আমাদিগের তাহা ধর্ম হইতে পারে না কখনও  | সমসাময়িকতার যে ধুলিজালটি,একজন প্রকৃত মহাকবিকে,আচ্ছন্ন করিতে পারেনা কোনভাবেই--- আপন রচনাশরীরের সকল ত্রুটিবিচ্যুতিগুলিকে,আপন শক্তিবলে, তিনি এতটাই ছাপাইয়া উঠেন--- সেই ধুলিজালটিকে, আমাদের ন্যায় অল্পশক্তিধর গীতিকবিদের, তাই এড়াইয়া চলিতেই হইবে যেকোনো মূল্যে | কবি আলোক সরকারের সংবেদনে তাই নন্দীগ্রাম সাড়া তুলিতেই পারে; একটা সরকারি পুরস্কারও,অর্থ- মূল্যসহ, তিনি ফিরাইয়া দিতেই পারেন সেই প্রতিক্রিয়াবসত; কিন্তু তাঁহার কবিতায়, নন্দীগ্রামের ধূলিমলিন রূপটিকে, তিনি প্রবেশ করিতে দিবেন না কিছুতেই, অন্তত সচেতনভাবে | দেন যদি,তাহাহইলে যে -নাতিমহৎ সুন্দরের সাধনাটি তিনি করিয়া আসিতেছেন আজীবনকাল, তাহা ক্ষতিগ্রস্তই হইবে |


... আমরা এমন কোনো ইঙ্গিত এখানে রাখিতে চাহিতেছি না যে ঐ সুন্দরটি সুন্দরই নহে, প্রকৃত অর্থে |  আমরা শুধু এই প্রশ্ন টুকুই মাত্র তুলিতে চাহিতেছি এখানে,যে 'সুখ' আর 'আনন্দে'র মধ্যে যে-পার্থক্যটা রবীন্দ্রনাথ নির্দেশ করিয়াছিলেন একদিন, যখন তিনি বলিয়াছিলেন--- তাঁহার অনবদ্য ভাষায়--- যে সুখ পাছে গায়ে ধুলাটুকু লাগে এই ভয়ে সন্ত্রস্ত, আর আনন্দ ঐ ধুলা মাখিয়াই যেন আরও আনন্দিত, আরও বিকশিত--- সেই একই পার্থক্যরেখাটি কি বর্তমান নাই গীতিকবির এই ক্ষুদ্র সুন্দর আর মহাকবির ওই মহৎ সুন্দরের মধ্যেও? ক্ষুদ্র আনন্দ বলিয়া যেমন কিছু হয়না,প্রকৃত অর্থে---সুখসর্বস্ব মানুষের যেমন বস্তুত কোন ধারনাই থাকিতে পারে না প্রকৃত 'আনন্দ' নামক জিনিসটার আস্বাদ সম্পর্কে--- তেমনই সমসাময়িক জগতের সকল ধূলিমলিনতাকেই সভয়ে এড়াইয়া চলে যে 'সুখী' কবিতা প্রকৃত 'সুন্দরে'র দর্শনও কি সে লাভ করিতে পারিবে কোনোকালে?---ধূলিই যে সুন্দরের আশ্রয়?---ভস্মই যে- সুন্দরের প্রসাধন?---পঙ্কই যে -সুন্দরের চন্দন?


... রবীন্দ্রনাথকে তাহার মহত্ত্বের স্বীকৃতিস্বরুপ, 'মহাকবি'ই আমরা বলিয়া থাকি বটে--- কিন্তু আদতে, খাঁটি 'মহাকবি'- গোত্রীয় মনুষ্য যে তিনি ছিলেন না কোনোভাবেই;বরং আমাদিগের ন্যায়ই একজন আপন বেদনা বিধুর, বিস্ময়বিহ্বল  গীতিকবিই যে ছিলেন মূলত;ইহা সাধারণত ভুলিয়াই থাকা হয় বর্তমানকালে | একজন মধুসূদন,বা এমনকি একজন জীবনানন্দও, যে অর্থে মনোগঠনের দিক হইতেই অনেকটা মহাকবি গোত্রীয়,কোন সচেতন আঙ্গিক নির্বাচনের কারণে বা মহৎ কাব্য সিদ্ধির কারণেই কেবল নহে;সে অর্থে একজন 'মহাকবি' যে তাঁহাকে বলা যাইতে পারে না কোনোভাবেই, তাঁহার গদ্য রচনায় জটিল, গম্ভীর দূরান্বয়িত বাক্যপরম্পরার আপেক্ষিক অসদ্ভাব, এবং তাঁহার কাব্যে, এমনকি সনেটের ন্যায় প্রথাবদ্ধ কাব্য গঠনেও, অন্তমিলসজ্জার অতিসরল বিন্যাসক্রম(ক-ক-খ-খ-গ -গ- ঘ -ঘ,এইরূপ বিন্যাস; ক -খ -খ -ক- গ -ঘ -ঘ -গ বা ক-খ-গ-ঘ ক-খ-গ-ঘ জাতীয় বিন্যাস গুলির পরিবর্তে) সেই সত্যের দিকেই সুস্পষ্ট অঙ্গুলিনির্দেশ করিতেছে মাত্র | এ প্রসঙ্গে পূর্বে আমরা বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছি, সুতরাং এখানে আর তাহার অযথা পুনরাবৃত্তি করিব না | যাঁহার প্রয়োজন হইবে, তিনি 'অনুবর্তন' খুলিয়া বর্তমান লেখকের 'রবীন্দ্রনাথ,অসম্পূর্ণ সাধনা'( দ্বাদশ খন্ড বৈশাখ-আষাঢ় চৌদ্দশ পাঁচ) শীর্ষক প্রবন্ধ টি যদি একবার দেখিয়া লয়েন, তাহা হইলেই এই সত্যটি হয়তো সহজেই মানিয়া লইতে পারবেন, যে রবীন্দ্রনাথ, 'মহাকবি'হইয়াই ঠিক জন্মান নাই  বোধহয় 'মহাকবি' আপন সাধন বলে তিনি হইয়া উঠিয়াছিলেন ক্রমশ |


... কাল, এখানে স্মরণ করিতেই হইবে, যে তাহার সহিতই ছিল | তাঁহার সহায়ই ছিল | উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের যে নবজাগ্রত নাগরিক বঙ্গদেশে তিনি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহা কেবল ভাবেরই নহে, পরন্তু কর্মেরও নানামুখী উৎসাহে,উদ্দীপনায় এমনই স্পন্দিত ও নন্দিত ছিল, যে 'চিত্রা'র 'এবার ফিরাও মোরে' কবিতাটি, ঐ বিশেষ স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করিবার কারণেই হয়তো, তাঁহার ন্যায় একজন অতি সংবেদী শিল্পীকে, আপন স্বভাবের খানিকটা বিপরীতে গিয়াও, লিখিয়া ফেলিতে একরূপ বাধ্যই হইতে হইয়াছিল বলিয়া আমাদের মনে হয় আজ |'ঘরে-বাইরে'র বিমলার ন্যায় তিনিও যেহেতু, হয়ত ওই কালের দুর্মর প্রভাবেই, মনে প্রাণে বিশ্বাস করিতেন, যে  স্বভাবের বিরুদ্ধে যাওয়াই আমাদের স্বভাব | আপনাকে তীব্র ভর্ৎসনা করিয়া তাই তাঁহাকে বলিতেই হইয়াছিল, আত্মসমীক্ষণের, আত্মপরিক্ষনের সেই ক্রান্তিক্ষণটিতে, যে:

"সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শতকর্মে রত,
 তুই শুধু ছিন্ন বাধা পলাতক বালকের মত
 মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষন্ন তরুচ্ছায়ে
 দূর বনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্তবায়ে
 সারাদিন বাজাইলি বাঁশি | ওরে তুই ওঠ আজি |
 আগুন লেগেছে কোথা?কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি
 জাগাতে জগৎ জনে? কোথা হতে ধ্বনিছে ক্রন্দন
 শূন্যতলে? কোন অন্ধকারা মাঝে জর্জর বন্ধন
 অনাথিনী মাগিছে সহায়?......
 এবার ফিরাও মোরে, লয়ে যাও সংসারের তীরে
 হে কম্পনে রঙ্গময়ী | দুলায়োনা সমীরে সমীরে
 তরঙ্গে তরঙ্গে আর, ভুলায়োনা মোহিনী মায়ায় |
 বিজন বিষাদঘন অন্তরের নিকুঞ্জ ছায়ায়
 রেখো না বসায়ে আর |......
সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টি-মাঝে বহুদিন করিয়াছি বাস
 সঙ্গীহীন রাত্রিদিন; তাই মোর অপরূপ বেশ,
 আচার নূতনতর, তাই মোর চক্ষে স্বপ্নাবেশ,
 বক্ষে জ্বলে ক্ষুধানল | যেদিন জগতে চলে আসি,
 কোন মা আমারে দিলি শুধু এই খেলাবার বাঁশী |
 বাজাতে বাজাতে তাই মুগ্ধ হয়ে আপনার সুরে
 দীর্ঘদিন দীর্ঘরাত্রি চলেগেনু একান্ত সুদূরে
 ছাড়ায়ে সংসার সীমা |সে বাঁশিতে শিখেছি যে সুর
 তাহারি উল্লাসে যদি গীত শুন্য অবসাদপুর
ধ্বনিয়া তুলিতে পারি, মৃত্যুঞ্জয়ী আশার সঙ্গীতে
 কর্মহীন জীবনের এক প্রান্ত পারি তরঙ্গিতে
 শুধু মুহূর্তের তরে, দুঃখ যদি পায় তার ভাষা,
 সুপ্তি হতে জেগে ওঠে অন্তরের গভীর পিপাসা
 স্বর্গের অমৃত লাগি ---তবে ধন্য হবে মোর গান,
 শত শত অসন্তোষ মহাগীতে লভিবে নির্বাণ |........ "


 ... আত্মভর্ৎসনার,আত্মশুদ্ধির এই জ্বলন্ত অঙ্গার খণ্ডটি ---আমরা,এই একুশ শতকীয় বঙ্গীয় গীতিকবিরা ---দুই চারিটি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ উপেক্ষা করিলে---আর হৃদয়ে বহন করিনা প্রায় কেহই | যদিও,একজন স্বভাবমুগ্ধ গীতিকবিও, মহাকবিরূপ একটি হীরকখন্ডে কিন্তু পরিণত হইতেই পারেন; বা সেই পথে, কয়েকটি পদক্ষেপও অন্তত, অগ্রসর হইতেই পারেন; যদি ওই পূর্বোল্লিখিত অঙ্গার খণ্ডটি,তাঁহার হৃদয় দেশে প্রজ্জলিত থাকে, আপনার উজ্জ্বলবিভায় | তাঁহার  রচিত গীতিকবিতাবলীর জাত ত তাহাতে যায়ই না, বরং শৈল্পিক উৎকর্ষের বিচারে তাহা উন্নততরই বোধহয় হইয়া থাকে সমধিক---স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেই যেমনটা ঘটিয়াছিল(যেহেতু গীতিকবিতা ও মহাকবিতা,প্রকৃত প্রস্তাবে, দুইটা বিপরীত বর্গ নহে কোনো ক্রমেই--- দ্বিতীয়টা, প্রথমটার একটা জটিলতর, উন্নততর বিকাশই মাত্র,যেহেতু 'লিরিক' স্তর হইতে, মধ্যের 'ড্রামাটিক' স্তরটি পার হইয়াই, 'এপিকের' জন্ম) | এবং যেমনটা ঘটিয়াছিল হয়তো স্বল্পতর মাত্রায়,তবু তাঁহার পরবর্তী প্রধান কবিদের ভিতর কেবল জীবনানন্দেরই নহে, অমিও চক্রবর্তী,সুধীন্দ্রনাথ দত্ত,সঞ্জয় ভট্টাচার্য,এবং বিষ্ণু দে'র ক্ষেত্রেও | আর যেমনটা ঘটেনাই, ঘটিয়া উঠিতে পারেনাই বলিয়াই,বুদ্ধদেব বসু বা অজিত দত্তের কবিতা, তাঁহাদের অন্যান্য নানা গুণাবলী সত্ত্বেও, একটা সুগভীর সীমাবদ্ধতা কিন্তু আর অতিক্রম করিয়া উঠিতে পারিল না যেন কিছুতেই | যেহেতু তাঁহাদের হৃদয়দেশে ঐ পূর্বোল্লিখিত অঙ্গার-খণ্ডটি, বোধহয় প্রজ্জলিত ছিলনা অহোরাত্র | যাহা একজন কবিকে, শিল্পীকে, সাধককে---সুখে সীমাবদ্ধ হইতে দেয় না;ক্ষুদ্র সুন্দরে মোহোমুগ্ধ হইতে দেয় না; একটি তাত্ত্বিক শুভবোধেই মাত্র, আত্মতৃপ্ত হইতে দেয়না কোনোভাবেই | তাহার শিকড়ের সহিত একটি নিবিড় সম্পর্কে, সচেতনায়---  তাহাকে যুক্ত করে | এবং মুক্তও করে | আপনার অতিক্ষুদ্র সত্তাটির অন্ধ কারাগারটি হইতে 

... মঙ্গল একটি সার্বভৌমিক, সর্বাতিশায়ী মহাজাগতিক সুমঙ্গল--- যে সর্বদা ঘাটিয়াই আছে,এবং ঘাটিয়াই চলিতেছে অহর্নিশ ---আমাদের দৃষ্টিশক্তির অভাবেই  যে কেবল তাহা আমরা দেখিতে পাইতেছিনা সর্বদা, সর্বথা--- ইহাকে একটি তত্ত্বমাত্র নহে, বরং একটি পরম সত্য বলিয়াই আমরা যাহারা উপলব্ধি করিয়াছি সত্যসত্যই; আমরা--- মহাকবির যে-সকল চেলারা--- ভয়ঙ্করকেও,এমন কি মহা- প্রলয়ঙ্করকেও, সুন্দর বলিয়াই জানিয়াছি শেষত--- আর তাই, বিরাট আকাশের নিচে, বজ্রদগ্ধ, ন্যাড়া তালগাছের সৌন্দর্যেও মুগ্ধ হইয়াই আসিয়াছি চিরকাল;যোগের সৌন্দর্যের পাশাপাশি বিয়োগের সৌন্দর্য লইয়াও কাব্য রচনা করিয়াছি, নাট্যরচনা করিয়াছি, সংগীত রচনা করিয়াছি শতকোটি; তাহারা কি ইহাও বুঝিনাই, বুঝিয়া কাঁদিনাই, কাঁদিয়া পুনর্বার হাসি নাই, যে ঐ সত্যটি বস্তুত এত বড় একটা সত্য, এমন অতিশায়ী একটা সত্য,যে আমরা, ক্ষুদ্র মনুষ্যদেহধারীরা, ঐ সত্যের আভাসটুকু পাইয়া হয়তো ধন্য হইয়া যাইতে পারি কেহ কেহ ---হয়তো পশুজীবন হইতে প্রকৃত মনুষ্য জীবনে রূপান্তরিত হইয়া যাইতে পারে, ঐ সত্য দর্শনের ফলে, আমাদের ভিতর কোন কোন ভাগ্যবানের প্রাতিস্বিক জীবননাট্যগুলি--- কিন্তু ঐ সত্যেই সর্বদা বসবাস করিতে আমরা কেহই কোনো ক্রমেই পারি না? এই মানুষ্য দেহ লইয়া?--- যেহেতু এই মনুষ্য দেহের, এই মানুষ্য সমাজের, একটা ক্ষুদ্রতর মঙ্গল-অমঙ্গলের,কল্যাণ-অকল্যাণের,সুন্দর-অসুন্দরের, এমনকি সত্য অসত্যের ধ্যান-ধারণাও,থাকিয়াও যায়ই কোথাও একটা, আমাদের অন্তর্লোকে--- যে ধ্যান-ধারণাকে বিসর্জন দেওয়া যায়, বিসর্জন দেওয়ার অধিকার টি লাভ করা যায় কেবল ওই চূড়ান্ত সত্যটিতে চিরদিনের ন্যায় সমাধি লাভ করিতে পারিলে, তবেই ?


...বুদ্ধ ইহা বুঝিয়েছিলেন, যীশু ইহা বুঝিয়াছিলেন, মহম্মদ ইহা বুঝিয়াছিলেন(যে কারণে তাঁহাকে মরমী ভাবুক বেয়াজিদ বোস্তামী-র উপরেই স্থান দিয়াছিলেন কবি জালাল উদ্দিন রুমী-র প্রদর্শক ও 'বন্ধু' শামস উদ্দীন)| শংকরও ইহাই বুঝিয়াছিলেন আবার রবীন্দ্রনাথকেও, তাঁহার মত করিয়া, ইহাই বুঝিতেই হইয়াছিল | 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে'র পরও, অথবা বলা যাইতে পারে, পরই, 'এবার ফিরাও মোরে', তাই অনিবার্যই ছিল একপ্রকার | যেমন অনিবার্যই ছিল, 'গীতাঞ্জলি'র পর 'বলাকা'ও |


... অনিবার্যই ছিল, কারণ ওই চরম সমাধি,ওই পরম পরিনির্বাণ, যিনি লাভকরিবেন যথার্থই অন্তরে,তিনি আর যাহাই করুন না কেন,কবিতা বোধহয় আর লিখবেন না, হাতে কলম ধরিয়া গ্রন্থও, আর ছাপাইবেন না | আমরা, যাহারা কলম ধরিয়া কবিতারচনা করি আজও; গ্রন্থও ছাপাই; তাহারা বড়জোর যোগভ্ৰষ্ট,সমাধিভ্ৰষ্ট প্রতিভাবানই মাত্র | ঐকান্তিক যোগের পথে, অথবা বৈদান্তিক 'ব্রহ্মসদ্ভাবে -র'বা ভাবসমাধির পথে,যে সত্যের একটি পদনখকণামাত্র আমরা লাভ করিআছি, আমাদের জন্মান্তরীন কোন পুণ্যের, কোন সাধনার ফল স্বরূপ;সে সত্যে অহোরাত্র অবস্থান করা, আমাদের সাধ্যাতীতই, যদিও, ইহাও অনস্বীকার্য, যে সেই পরম সত্যের সহিত একটা লেনাদেনা,  একটা বোঝাপড়া,সর্বদা চলতেই থাকে আমাদের অন্তরে, আমাদের সমস্ত জীবন ধরিয়া। আমাদের সকল কর্ম, যদি সত্য কর্ম হয়; আমাদের সকল বাক্য, যদি সত্য বাক্য হয়; তবে সেই পরমের একটি স্পর্শ, তাহাতে লাগিয়াই থাকে ঠিক। যেমন লাগিয়া থাকে, দুর্মোচনীয়ভাবেই, এই ধূলিমলিন মাতৃপ্রকৃতিরও,  একটি জন্মগত নাভি চিহ্নও। এই দুই সত্যের সঙ্গমজাত একটা তৃতীয় সত্যে, আমরা হয়তো তখন স্থিত হইতে পারি, প্রকৃতই।এবং ঐ দ্বিতীয় তথা অদ্বিতীয় সত্যযুগলের যৌথ,আপাতবিরোধী, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে পরস্পরের সহিত সম্পূরক সম্পর্কে যুক্ত বার্তাযুগলের কোনোটিকেই পরিহার না করিয়া; মাতা এবং পিতা, ভূমি এবং আকাশ, এই উভয় উপাদানকেই তুল্যমূল্য, এবং আমাদের এই মানবজীবনের, মানব জন্মের পরম চরিতার্থতার জন্য সমানই মূল্যবান বলিয়া জ্ঞান করিয়া;এই উভয়েরই উভমুখী প্রচারই, শতমুখে করিয়া যাইবার চেষ্টাটুকুই শুধু করিতে পারি তখন আমরা সারা জীবন ধরিয়া। আমাদের কাব্যেও যেমন; আমাদের নিত্য কর্মেও, নিত্যকার জীবনযাপনেও ঠিক তেমনই। কে যে বলেছিলেন কথাটা, ভুলিয়াছি;কিন্তু মূল কথাটা আজিও ভুলিতে পারি নাই দেখতেছি, যে,কবি যখন নিচুহইয়া জুতার ফিতাটিও বাঁধিবেন,তখনও তাহা কবির মত বাঁধিবেন। অর্থাৎ কবি নিত্যকার জীবনের সহিত তাঁহার কাব্যলোকের, তাঁহার বাস্তবের সহিত তাঁহার সত্যের, একটা অলঙ্ঘনীয় দূরত্ব কখনোই থাকিবেনা কোনভাবেই। ভিত্তিমূল্যে তিনি কখনও ভবিষ্যৎ খরিদ করিতে চাহিবেন না


...আমাদের তথাকথিত 'আধুনিক কবি'দের লইয়া, আমাদের  সর্বাপেক্ষা বৃহৎ অস্বস্তিটা, বস্তুত এইখানেই। শ্রী বুদ্ধদেব বসু-প্রদর্শিত পাথরেখাটি অনুসরণ করিয়া,তাঁহারা আজপর্যন্ত একভাবে বাঁচেন, আর একভাবে লেখেন। লেখার জগতটা, তাঁহাদের নিকট, একটা তথাকথিত 'বিশুদ্ধ'  জগৎ--- যেখানে পালাইয়া,বাহিরের এই ধূলিমলিন, নানা দ্বন্দ্ব-সমাকীর্ণ 'অশুদ্ধ' জগৎটা হইতে, তাঁহারা যেন একটা নিষ্কৃতিলাভই করিতে চাহেন প্রাণপণে।সেহেতু তাঁহাদের সত্যলোকটা কাব্যলোকটা,---যতখানি সৃষ্টি,তাহার অধিক নির্মাণ; যতখানি সত্য তাহার অধিক তত্ত্ব। সেই নির্মিত সুন্দর কে, আরও নিখুঁত করিয়া, আরও রুপবান করিয়া, আরও শ্বাসরুদ্ধকর করিয়া গড়িয়া তুলিবার দিকেই, তাঁহাদের সারাজীবনের পরিশ্রমটা,এমনকি সাধনাটাও, নিয়োজিত হয় যেকারণে। আপনার জীবন টাকে, মানবিক অস্তিত্বটাকে সুন্দর করিবার দিকে, সম্পূর্ণ করিবার দিকে,সার্থক করিবার দিকে নিয়োগ করিবার মত সময় বা সাধনশক্তি আর-কিছুই তাই উদ্বৃত্ত থাকে না তাঁহাদের পুঁজিতে। একজন আলোক সরকারের ন্যায় তাঁহারা তখন অনায়াসে বলিতেই পারেন কেহ;" কোনো বিবেচনাতেই সমাজের প্রতি সামান্যতম কর্তব্য পালন করতে পেরেছি ব'লে মনে হয় না। "(সাক্ষাৎকার,নীলিমা চৌধুরী কর্তৃক গৃহীত;'উপাংশু', বইমেলা 2008)।


... বলিতে হয়তো পারেন, প্রচলিত অর্থে যাহাকে সৎ লোক বলা হইয়া থাকে, সেইরূপ কোন মানুষ হইলে; কিন্তু বিনীত আত্মলাঘবের ছদ্দবেশে ইহা যে কতবড় একটা অক্ষমতারই,  কত বড় একটা ব্যর্থতারই স্বীকারোক্তি প্রকৃতপক্ষে, তাহা বোধহয় তাঁহারা ভাবিয়াও দেখেন না একবারও। দেখিতেন যদি, তাহা হইলে এত সরলভাবে, এত যন্ত্রণাচিহ্নহীন ভাবে, কথাটা বলিয়া ফেলা, বোধ হয় সম্ভবপর হইত না তাঁহাদের পক্ষে।


... তলস্তয়, তাঁহার দিনলিপিতে, এইরূপ একটি মন্তব্য করিয়াছিলেন একদা,যে কবিরা, শিল্পীরা,সাহিত্যিকরা তাঁহাদের কাব্যকে, শিল্পকে,সাহিত্যকে, সুন্দর করিতে চাহেন, মহনীয় করিতে চাহেন তাঁহাদের আপন আপন জীবনগুলির অসৌন্দর্যের, অচরিতার্থতার মূল্যে।--- ইহা কিন্তু--- কেহ যেন ভুল না বোঝেন--- অস্কার ওয়াইল্ডের সেই নাইটেঙ্গেলটির আত্মবলিদানের সহিত তুলনীয় নহে, যে বুকের ভেতর কাঁটাটি ফুটাইয়া, আপন রক্তধারার মূল্যে আপন সংগীতের রক্তকামলটিকে প্রাণদান করিয়া,নিজে মরিয়া যায় শেষত।---- সেই গায়ক পাখিটি কিন্তু,প্রকৃত প্রস্তাবে,অচরিতার্থও নহে, অসুন্দরও নহে কোনো অর্থেই। মহাকবি হউক বা না হউক, সে অন্তত মহাকবিতার পথেই হাঁটিতে থাকা একজন গীতিকবিই। আমাদের 'আধুনিক' গীতিকবিদিগের সহিত তাহার জাতের পার্থক্যটা এইখানে, যে তাহার গান সরাসরি তাহার প্রাণ হইতে আসে; আর ইঁহাদের শিল্পটা আসে ইঁহাদের মাথার ভিতর দিয়া 'ফিল্টার্ড' হইয়া।---আবেগ নামক বস্তুটাকে সেই কারণেই ইঁহারা ভয় পান এতখানি।--- সত্য পদার্থকে, ঊনসত্যের উপাসকবৃন্দ--- ভয় পাইবেন না ত কী!


... ভয়, মানুষের ঐ সত্য আবেগকে, এই সত্য জগতকে, ইঁহারা অতি গভীরভাবে কোথাও পান বলিয়াই, ইয়েটসের সেই উক্তিটি প্রায়ই উদ্ধৃত করিয়া থাকেন তথাকথিত 'বিশুদ্ধ কবিতা'র সমর্থনে, যেখানে ইয়েটস,আপন স্বভাবের খানিকটা বিরুদ্ধে গিয়াই, এরূপ বলিয়া ফেলিয়াছিলেন কখনো, যে কবিতা হইতে বাদদিতে হইবে সেইসকল বস্তুকে, যাহা কবিতা নহে। কিন্তু কি কবিতা নহে? যদি প্রশ্ন করা যাইত ইয়েটস কে? কি বলিতেন তিনি?'কবিতা'বস্তুটাযে, উপনিষদের ব্রহ্ম এর ন্যায়ই,সর্বঘটেই বিরাজমান,কেবল প্রকৃত কবিদৃষ্টির অভাববসতই সর্বত্র তাঁহাকে দেখিতে পাই না আমরা, অস্বীকার করিতে পারিতেন কি তিনি এই সহজ সত্যটা?


...'বিশুদ্ধ কবিতা'র চর্চা, বাস্তবিক তাঁহাদেরই মানায়, যাঁহারা কবিতাকে একটি মার্গ বা পরাবিদ্যা হিসাবে না দেখিয়া আর পাঁচটা সাধারণ বিষয়ের বা অপরাবিদ্যার ন্যায় ---উদাহরণতঃ, পদার্থবিজ্ঞান বা ন্যায়শাস্ত্র বা অর্থনীতি বা ভূতত্ত্ব বা হিসাবরক্ষাশাস্ত্র বা পরিবেশবিদ্যার ন্যায় ---আর- একটা সাধারন বিষয় হিসাবেই মাত্র দেখেন, এবং সেই বিশেষ বিষয়টির একশ্রেণীর বিশেষজ্ঞ বুদ্ধিজীবীই মাত্র হইতে চাহেন, ঐ আর পাঁচটা তথাকথিত বৈজ্ঞানিক, নৈয়ায়িক বা অর্থনীতিবিদ-জাতীয় বুদ্ধিজীবীর ন্যায়ই।বিপরীতপক্ষে, আপনাকে কেবলই একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে ভাবিতে যে কবির একটি সুগভীর ঘৃণাবোধই বস্তুত হইয়া থাকে---যেহেতু মহাকবি জীবনান্দ কথিত


 সেই 'বোধে'র ,অর্থাৎ একটি প্রকৃত কবি দৃষ্টির তথা ঋষিদৃষ্টির, অন্তত আংশিক আভাসটুকুও তিনি পাইয়াছেন তাঁহার এ কবিজীবনে--- তিনি কদাচ কোন তথাকথিত 'বিশুদ্ধ কবিতা'র পথে নহে, বরং এমন একটি পথেই হাঁটিবেন, যাহাকে, যোগ্যতর কোন শব্দের অভা(হায় 'শব্দ'। কী গভীর তোমার সীমাবদ্ধতা!) বলা যাইতে পারে, 'সম্পূর্ণ কবিতা'র পথ--- যে পথ চলিয়া গিয়াছে,একদিকে যেমন মিটিং-মিছিল-ধর্ণা- অনশন- আন্দোলনের মধ্য দিয়া, অপরদিকে তেমনি দরিদ্র বসতিনিবাসী শিশুদিগের বা বৃদ্ধদিগের নিমিত্ত স্থাপিত কোন 'আনন্দ পাঠশালা'র মধ্য দিয়াও; একদিকে যেমন যম-নিয়ম-আসন-প্রাণায়ামের ভিতর দিয়া, অপরদিকে তেমনই স্মরণ-মনন-স্বাধ্যায়- নিদিধ্যাসনের ভিতর দিয়াও; একদিকে যেমন আর্তের, পীড়িতের, দিশাহীনের,ভাষাহীনের উষ্ণ, আতপ্ত লালাটদেশে জলপটি লাগাইবার মধ্য দিয়া,  অন্যদিকে তেমনি অন্নহীনের,বস্ত্রহীনের অন্ন-বস্ত্র যোগাইবার মধ্য দিয়াও; এক দিকে যেমন বালতিতে জলটানিয়া শুষ্ক বৃক্ষমূলে সেচনের মধ্য দিয়া, অন্যদিকে তেমনি দুইটা কুমড়াফুলের বড়া-ভাজা খাইবার আশায় মাতার রন্ধনগৃহের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করিবার মধ্য দিয়াও। আর যাহাই হউন বা না হউন না কেন এ জীবনে,কোন 'স্পেশালিস্ট' যে হইবেন না তিনি, এই তাঁহার ধনুক ভাঙ্গা পন।'একলা ঘরের কোণে' থাকিবেন না শুধু,আপনার 'মায়াবী টেবিল'টি আঁকড়াইয়া। পথ পথই তাঁহাকে টানিবে চিরদিন---যে পথ ক্ষুরধার ও নিশিত; যে পথ শহরের ও অরন্যের,সংগীতের ও শতরঞ্জের,নক্ষত্রের নীহারিকালোকের মধ্য দিয়া চলিয়া গিয়াছে অসীমের অভিসারে; যে পথে,একটি বিনা কোন নিশ্চয়তা নাই; যে পথে, পদে পদেই, পতনেরই সম্ভাবনা।মসৃণ হইবে না,কোনো অর্থেই মসৃণ হইবে না তাঁহার যাত্রাপথ। পুনঃ পুনঃ পতন ও উত্থানের মধ্য দিয়াই পথ কাটিতে হইবে তাঁহাকে, চিরদিনই সকল কবিকেই যেমন কাটিতেই হয়। অকবিতাকে তাই তিনি ভয় পাইবেন না কদাচ, যেমন ভয় পাইবেন না অপথ বা  বিপথকেও--- কারণ 'অকবিতা'বা 'অপথ' এই ধারণাগুলাকেই তিনি সমূহত প্রত্যাখ্যান করিবেন। তিনি জানিবেন, এবং উচ্চৈঃস্বরে গাহিবেনও, সেই গানটি:"…পথ  আপনায় আপনি দেখায়, তাই বেয়ে মা চলব সোজা--- যারা পথ দেখাবার ভীড় করে গো, তারা কেবল বাড়ায় বোঝা। " বোঝা ফেলিতে-ফেলিতে, তত্ত্ব আর তথ্যের জঞ্জাল নামাইতে-নামাইতে, তিনি চলিবেন---ঐ তত্ত্ব আর তথ্যের অরণ্য ভেদ করিয়াই, অকবিতা আর ঊনকবিতার আগাছা উপেক্ষা করিয়াই। যেহেতু, কোন তথাকথিত 'সবুজ বিপ্লবে'নহে,বরং 'প্রাকৃতিক কৃষি'তেই তিনি  আস্থাবান। যেহেতু, তিনি জানিয়াছেন, ঐ আগাছাই মাটিতে মিশিয়া গিয়া শ্রেষ্ঠ সারে পরিণত হয় ক্রমে---উহাকে ভয় করিবার কিছু নাই কোন প্রকৃত কৃষকের পক্ষে। যিনি কোন 'বিশেষজ্ঞ'নহেন কোন 'বুদ্ধিজীবী' নহেন কোনোকালে, যিনি কবি--- যাঁহার চৈতন্য রূপ নিড়ানির স্পর্শে, ঐ আগাছাও, ঐ আবর্জনা স্তুপও, ঐ আবেগপুঞ্জও ঐ অকবিতাও ---কবিতাই হইতে চাইতেছে, একটি গভীর মোক্ষলাভতৃষ্ণায়।


...এই 'চৈতন্য' শব্দটা অবশ্য, আমরা দেখিতে পাই, তথাকথিত 'বিশুদ্ধ কবি'রাও আবার, উচ্চারণ করিয়া থাকেন কেহ-কেহ। কিন্তু শুদ্ধ চৈতন্যের বিস্ফোরণ যে কোন শুষ্ক মেধার বা তত্ত্বের পথ নহে, বা এমনকি কোনো খেয়ালী কল্পনার পথেও নহে, পরন্তু  তীব্রতম কোন ভাবনার পথেই হইয়া থাকে, এই মৌলিক সত্যটি সম্পর্কে, আমরা বুঝিতে পারি, ইঁহারা অজ্ঞ।---শুদ্ধ আধ্যাত্মিক সাধনার পথে কোনদিন হাঁটা ত দূরে থাকুক, সে জগতের কোন ঘনিষ্ঠ খোঁজ-খবরও, ইঁহারা কোনোকালে রাখেন নাই বলিয়াই। ভারতবর্ষের সুবিপুল আধ্যাত্মসংস্কারের ঐতিহ্যটি, একেবারে কৈশোর দশা হইতেই ইংরেজি সাহিত্যের বা তুলনামূলক সাহিত্যের মাস্টারমশাইদের কাছেই মাথা মুড়াইয়া ফেলিবার কারণেই, ইঁহাদের অন্তরপ্রদেশে প্রবেশলাভ করিবার কোন পথ পায় নাই বলিয়াই।--- ইঁহারা তাই,আপন-আপন ক্ষুদ্রতাগুলিকে আড়াল দিবার জন্যই, সযত্নে নির্মাণ করিয়াছেন এই মীথটি, যে কবিরা, শিল্পীরা---যেমন নাকি বৈজ্ঞানিকরা, দার্শনিকেরাও---  সৃষ্টিছাড়া, সমাজ-ছাড়া একশ্রেণীর মনুষ্যবিশেষ।তাঁহাদের সৃজনকর্মের মধ্য দিয়াই নাকি কেবল তাঁহাদের সমাজসেবা; বা সমাজের কাছে তাঁহাদের ঋণশোধ। ইহার বাহিরে অন্য কোনপ্রকার সেবা তাঁহাদের নিকট আশা করাটাই নাকি সমাজের পক্ষে অন্যায়।


... তাহা হইলে আইনস্টাইন?রবীন্দ্রনাথ?রাসেল?নন্দলাল?-----উঁহারা  মহাবৈজ্ঞানিক, মহাকবি,  মহাদার্শনিক, মহাশিল্পী।---উঁহাদের কথা স্বতন্ত্র।


... মহতের পদাঙ্ক অনুসরণই যে 'পন্থা'--- এইরূপ একটা 'পথে'র দিশা--- এককালে কিন্তু ছিল আমাদিগের সেকালেও সকলেই রবীন্দ্রনাথ বা আইনস্টাইন হয়েন নাই নিশ্চয়ই! কিন্তু একদিকে যেমন ম্যাক্স বর্ণ বা মেঘনাদ সাহা হইয়াছিলেন; অন্যদিকে তেমনি হইয়াছিলেন হপকিন্স অতুলপ্রসাদও। 1905 এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, কেবল মহাকবির লেখনীকেই নহে এই শ্রেণীর বহু গীতিকবির কলমকেও ব্যবহার করিআই শক্তিসঞ্চয় করিতে  পারিয়াছিল যেকারনে।তথাকথিত 'আধুনিক কবিতা' বলিয়া একটা উপসর্গ---যাহা সনাতন গীতিকবিতারই একটা স্ববিরোধী, ব্যভিচারী উপধারাই মাত্র ---বাঙালি সমাজে দেহে তখনও প্রকট হইয়া দেখা দেয়নাই যেহেতু। একদিকে কৃত্তিবাসী তথা 'হাংরি' অশুদ্ধতা, এবং অন্যদিকে এই 'আধুনিক' 'বিশুদ্ধতা'র তথা বিশীর্ণতার বাড়াবাড়িতে, বাঙালির সেই গান ত অনেকদিন হইল গিয়াছেই;বাঙালির প্রাণও বোধহয় এইবার যাইতেই বসিয়াছে। যান্ত্রিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, আজিকার যে ঐতিহাসিক সংগ্রাম, তাহাতে গান কে সাথী না পাইলে, প্রাণ আর জিতিবে কীসের জোরে?......




ধ্রুপদি গদ্য -চার

 নীলাচলে জগন্নাথদেবের বিগ্রহ নিয়ে একটি কাহিনী আছে।  সমুদ্রে ভেসে এসেছিল ব্রহ্মদারু রূপে কৃষ্ণের নাভি।  রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দৈববা...